৫৮ বছর আগে যেভাবে ইসকনের যাত্রা শুরু, এটি কী বিশ্বে নি..ষিদ্ধ সংঘ

জুমবাংলা ডেস্ক : ইসকন (ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস) বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের যাত্রা শুরু হয় ৫৮ বছর আগে। এর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য ছিলেন অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ইসকন মূলত বৈষ্ণব ধর্মের একটি অংশ এবং ভগবান কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনামৃত সংস্কৃতি হাজার বছরের ধরে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদের অক্লান্ত চেষ্টায় এই অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়, লাখো মানুষ এর অনুসারী হন।

বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে সক্রিয় রয়েছে সংঘটি। এটির প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মন্দির নির্মাণ, ধর্মীয় উপদেশ দেয়া, শ্রীমদ্ভগবদগীতা প্রচার, ভক্তি কার্যক্রম এবং দাতব্য সংস্থা পরিচালনা।

বাংলাদেশে যাত্রা: বাংলাদেশে ইসকন খুবই সক্রিয় এবং দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি মন্দির পরিচালনা করে। সত্তরের দশকের শুরুতে এই দেশে সংঘটির কার্যক্রম শুরু হয়। রাজধানী ঢাকার স্বামীবাগ মন্দির, যা বর্তমানে ইসকনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এটি সংগঠনটির প্রথম কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইসকনের বাংলাদেশ শাখা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যেমন ধর্মপ্রচার, মন্দির পরিচালনা, এবং বার্ষিক রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন। স্বামীবাগ মন্দিরে ভক্তরা নিয়মিত কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন এবং ভগবানের সেবা করে থাকেন।

বাংলাদেশ ছাড়াও ইসকন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, মালয়েশিয়াসহ আরও অনেক দেশে সক্রিয় রয়েছে।

চিন্ময় গ্রেপ্তার ও বাংলাদেশে বিক্ষোভ: সোমবার (২৫ নভেম্বর) ইসকন বাংলাদেশের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায় এবং ইসকনের ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এবং তাদের অধিকারের পক্ষে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তার মূল বিষয় হলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশে জাতীয় পতাকার ওপর ইসকনের ধর্মীয় গেরুয়া পতাকা স্থাপন করা হয়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, এটিকে দেশের অখণ্ডতাকে অস্বীকার এবং অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা হিসেবে দেখানো হয়।

মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এই কার্যক্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ছাড়াও আরও ১৮ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়। আইন প্রয়োগকারী একাধিক সংস্থা এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলাটি দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ (ধারা ১২০(খ), ১২৪(ক), ১৫৩(ক), ১০৯ ও ৩৪)।

এই মামলাটি চট্টগ্রামে বিশেষ করে সনাতন সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম বিতর্ক ও বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে মামলাটি প্রত্যাহারের জোর দাবি করা হয়েছে এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।​

ইসকন একটি ধর্মীয় সংগঠন হলেও এটি মাঝেমধ্যে বিতর্কের মুখে পড়ে যায়। এর কারণের মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। সংগঠনটি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলে যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিরোধ স্পষ্ট করে। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর কট্টরপন্থীরা ইসকনের কার্যক্রমকে তাদের নিজস্ব মতাদর্শের জন্য হুমকি মনে করেন। এদিকে, ইসকনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি নেতৃত্বে স্বার্থে আন্তঃসংঘাতের অভিযোগ উঠেছে।

তবে সমালোচনা এবং বিতর্ক সত্ত্বেও ইসকন অনেক দেশে তাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক কাজের জন্য সমাদৃত এবং প্রশংসিত। বিশেষত তাদের বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি (ফুড ফর লাইফ) বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত।

ইসকন কোন দেশে নিষিদ্ধ কী: ইসকন কিছু দেশে নিষিদ্ধ বা এদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি সাধারণত স্থানীয় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে আরোপ করা হয়েছে। রাশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে ইসকনের কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। বিশেষত, তাদের শাস্ত্র এবং ধর্মীয় বই বিতরণ নিয়ে বিতর্ক চরমে উঠেছে।
কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের মতো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ইসকনের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি জারি রয়েছে।

কিছু মুসলিমঅধ্যুষিত দেশে ইসকনের কার্যক্রমে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, তবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ইসকন বিশেষত হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার পক্ষে সরব অবস্থানে রয়েছে। তারা প্রায়ই মন্দির ধ্বংস, মূর্তি অবমাননা, এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়গুলোকে তথ্য-প্রমাণাদিসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরে। এ কারণে অনেক সময় তারা প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা সরকারের বিরাগভাজন হয়ে থাকে। অনেকে দাবি করেন, বাংলাদেশেও ইসকন সংখ্যালঘুদের পক্ষে সোচ্চার অবস্থানের কারণে তাদের নেতারা গ্রপ্তার ও মামলার হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ: ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনামৃত সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শ্রীল প্রভুপাদের অক্লান্ত চেষ্টায় এই অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়। লাখো মানুষ তার অনুসারী হয়ে যান।

শ্রীল প্রভুপাদ-এর জন্মগত নাম অভয় চরণ দে। তিনি ১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্ম নেন। তরুণ অবস্থায় তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে প্রখ্যাত পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক নেতা শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন তিনি অভয় চরণকে ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্বের কাছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করেন।

১৯৩৩ সালে অভয় চরণ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার নির্দেশ পালনে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। পরবর্তী ৩২ বছর তিনি বিভিন্ন সময় পশ্চিমাবিশ্বের দেশগুলোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।

১৯৬৫ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি একটি পণ্যবাহী জাহাজ ‘জলদূত’-এ বিনামূল্যে যাত্রার অনুমতি পান। তবে সেই সমুদ্রযাত্রাটি ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং ভয়াবহ। তিনি সেই যাত্রায় দুইবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ ৩৫ দিনের যাত্রার পর নিউইয়র্কে একটি নির্জন ব্রুকলিন বন্দরে তিনি পৌঁছান। তার সঙ্গে ছিল মাত্র সাত ডলার সমমূল্যের ভারতীয় রুপি এবং কিছু পবিত্র সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদিত বই।